পবিত্র শবে বরাতে আমল ফজিলত সকল কিছু সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন এবং ইসলামের আলোকে শবে বরাত।
শবে বরাত, যা লাইলাতুল বরাত নামেও পরিচিত, ইসলামের অন্যতম মহিমান্বিত রাতগুলোর মধ্যে একটি। এটি হিজরি বর্ষপঞ্জির শাবান মাসের ১৫ তারিখে পালিত হয়। মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, এই রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের গুনাহ ক্ষমা করেন, রিজিক নির্ধারণ করেন এবং তাদের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেন। এটি এমন একটি রাত যখন আল্লাহর অশেষ রহমত ও করুণা বান্দাদের প্রতি বর্ষিত হয়।
এই প্রবন্ধে শবে বরাতের গুরুত্ব, ফজিলত ও বিশেষ আমল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
শবে বরাতের ফজিলত
- গুনাহ মাফের রাত:
- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“শাবান মাসের ১৫তম রাতে আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে নেমে আসেন এবং ঘোষণা দেন— কে আছো, ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব। কে আছো, রিজিক চাইবে? আমি তাকে রিজিক দেব। কে আছো, বিপদমুক্তি চাইবে? আমি তাকে মুক্তি দেব।” (ইবন মাজাহ, হাদিস: ১৩৮৮)
- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
- তাকদির লিপিবদ্ধ করা হয়:
- কুরআনে এসেছে: “এ রাতে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়।“ (সুরা আদ-দুখান: ৪)
- রাসুল (সা.) অধিক ইবাদত করতেন:
- হজরত আয়েশা (রা.) বলেন:
“আমি এক রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, তিনি জান্নাতুল বাকীতে (কবরস্থানে) আছেন এবং আল্লাহর কাছে উম্মতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন।” (মুসনাদ আহমদ)
- হজরত আয়েশা (রা.) বলেন:

শবে বরাত সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে বিভিন্ন স্থান উল্লেখ রয়েছে। যদিও সরাসরি “শবে বরাত” শব্দটি কুরআনে নেই, তবে কিছু ব্যাখ্যাকারী মনে করেন যে, সূরা আদ-দুখানের ৩-৪ নম্বর আয়াতে এই রাতের ইঙ্গিত রয়েছে:
“আমি এক মহিমান্বিত রাতে কুরআন অবতীর্ণ করেছি। সে রাতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়।”
হাদিসেও শবে বরাতের গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“শাবান মাসের পনেরো তারিখের রাতে আল্লাহ প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং ঘোষণা করেন: কে আছে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব? কে আছে রিজিক চাইবে, আমি তাকে রিজিক দেব? কে আছে বিপদমুক্তি চাইবে, আমি তাকে মুক্তি দেব?” (ইবন মাজাহ, হাদিস: ১৩৮৮)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে শবে বরাত হচ্ছে এক বিশেষ রহমতের রাত, যেখানে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের বিশেষভাবে ক্ষমা করেন ও তাদের দোয়া কবুল করেন।
শবে বরাতের বিশেষ আমল
এই রাতটি ইবাদতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও শাবান মাসে বেশি বেশি ইবাদত করতেন। এই রাতে নিম্নোক্ত আমলগুলো করা যেতে পারে:
১. নফল নামাজ আদায়
শবে বরাতে নফল নামাজ পড়ার বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
- দুই রাকাত করে অন্তত ৮ বা ১২ রাকাত নামাজ পড়া উত্তম।
- প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়া যেতে পারে।
- দীর্ঘ সময় সিজদায় থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।
এ রাতে কুরআন তিলাওয়াত করা অত্যন্ত পুণ্যের কাজ। বিশেষত, সূরা ইয়াসিন, সূরা দুখান এবং সূরা মুলক তিলাওয়াত করা ভালো।
৩. তাওবা ও ইস্তিগফার করা
শবে বরাত হচ্ছে গুনাহ মাফের রাত। তাই এ রাতে বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তিগফার করা উচিত। নিম্নলিখিত দোয়াটি পড়া যেতে পারে:
اللهم إنك عفو تحب العفو فاعف عني
(উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’আননি)
অর্থ: “হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালোবাসো, তাই আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
৪. দরুদ শরিফ পাঠ
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। বিশেষত নিম্নলিখিত দরুদ বেশি বেশি পড়া উচিত:
اللهم صل على سيدنا محمد وعلى آل سيدنا محمد كما صليت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم إنك حميد مجيد
৫. দোয়া করা
এ রাতে নিজের, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং পুরো মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করা উচিত।
৬. কবর জিয়ারত
রাসুলুল্লাহ (সা.) এই রাতে কবরস্থানে গিয়ে দোয়া করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন:
“এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে খুঁজতে বের হয়ে দেখি, তিনি জান্নাতুল বাকীতে (মদিনার কবরস্থান) আছেন এবং কবরবাসীদের জন্য দোয়া করছেন।” (মুসনাদ আহমদ)
- নফল নামাজ:
- ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট কোনো রাকাত নেই। তবে ২, ৪, ৬, ৮, বা ১২ রাকাত নামাজ পড়া যেতে পারে।
- কুরআন তিলাওয়াত:
- কুরআন মাজিদ পাঠ করা এবং তাফসির বোঝার চেষ্টা করা উচিত।
- তাহাজ্জুদ নামাজ:
- এ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়লে আল্লাহ তাআলা বিশেষ রহমত দান করেন।
- তাওবা ও ইস্তেগফার:
- গুনাহ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
- দুরুদ শরিফ পাঠ:
- বেশি বেশি দুরুদ শরিফ পড়া সুন্নত ও বরকতময়।
- মাগফিরাতের দোয়া:
- এই রাতে আল্লাহ তাআলার কাছে নিজের, পরিবারের ও সমগ্র উম্মতের জন্য দোয়া করা উচিত।
- কবর জিয়ারত:
- রাসুলুল্লাহ (সা.) শবে বরাতে কবর জিয়ারত করতেন, তাই আমরাও করতে পারি।
এই রাতে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা ও কল্যাণ কামনা করে নিচের দোয়াগুলো পড়তে পারেন:
- اللهم اغفر لي ما قدمت وما أخرت، وما أسررت وما أعلنت
(অর্থ: হে আল্লাহ! আমার পূর্বের ও পরের, গোপন ও প্রকাশ্য সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করুন।)
- ربنا آتنا في الدنيا حسنة وفي الآخرة حسنة وقنا عذاب النار
(অর্থ: হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ দান করুন, আখিরাতে কল্যাণ দান করুন এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।)
শবে বরাত সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা ও বিদআত
১. শবে বরাত উপলক্ষে বিশেষ খাবার খাওয়া বাধ্যতামূলক নয়
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে শবে বরাতে হালুয়া-রুটি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এটি কোনো ধর্মীয় বিধান নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক প্রথা।
২. ১০০ রাকাত নামাজ পড়ার নির্দিষ্ট বিধান নেই
কিছু মানুষ মনে করেন, শবে বরাতে ১০০ রাকাত নামাজ পড়তে হবে। এটি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে ইচ্ছা করলে অতিরিক্ত নফল নামাজ পড়া যেতে পারে।
৩. পটকা ফুটানো ও আতশবাজি করা হারাম
কিছু দেশে শবে বরাত উপলক্ষে আতশবাজি ও পটকা ফুটানোর রীতি প্রচলিত আছে, যা ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
৪. একে অপরকে “শবে বরাত মোবারক” বলা
এটি একটি নতুন প্রচলিত সংস্কৃতি, যার কোনো ইসলামী ভিত্তি নেই।
আমরা কেন শবে বরাত পালন করবো
আমরা শবে বরাত পালন করি কারণ এটি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত, যেখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য রহমত, মাগফিরাত (ক্ষমা) এবং মুক্তির দরজা খুলে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসকে গুরুত্ব দিতেন এবং বেশি বেশি ইবাদত করতেন, যা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।
শবে বরাত পালন করার কারণসমূহ:
১. গুনাহ মাফের রাত
শবে বরাতে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করেন। হাদিসে এসেছে—
“শাবান মাসের ১৫তম রাতে আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং ঘোষণা করেন: কে আছো ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করবো? কে আছো রিজিক চাইবে, আমি তাকে রিজিক দেব?” (ইবন মাজাহ, হাদিস: ১৩৮৮)
২. তাকদির নির্ধারণের রাত
অনেক ব্যাখ্যাকারী মনে করেন, সূরা আদ-দুখানের ৩-৪ আয়াতে শবে বরাতের ইঙ্গিত রয়েছে:
“আমি এক মহিমান্বিত রাতে কুরআন নাজিল করেছি, যেই রাতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়।”
এই রাতেই এক বছরের জন্য মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।
৩. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আমল
রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন এবং ইবাদতে ব্যস্ত থাকতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন—
“আমি কখনো রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে শাবান মাসের চেয়ে বেশি রোজা রাখতে দেখিনি।” (বুখারি, হাদিস: ১৯৬৯)
৪. দোয়া ও ইবাদতের গুরুত্ব
এই রাতে বেশি বেশি নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত, ইস্তিগফার ও দরুদ পাঠের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
৫. কবরবাসীদের জন্য দোয়া
রাসুলুল্লাহ (সা.) শবে বরাতে কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের জন্য দোয়া করতেন। তাই কবরবাসীদের জন্য দোয়া করাও গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
শবে বরাত হলো রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের রাত। এই রাতে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য বান্দার গুনাহ মাফ করেন এবং তাদের তাকদির নির্ধারণ করেন। আমাদের উচিত এই রাতকে যথাযথভাবে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটানো এবং বিদআত ও কুসংস্কার থেকে দূরে থাকা।
আমরা শবে বরাত পালন করি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য, গুনাহ মাফের জন্য এবং ভবিষ্যৎ জীবনের কল্যাণের জন্য।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে শবে বরাতের ফজিলত অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
শবে মেরাজের আমল ও ফজিলত সম্পর্কে জেনে নিন
Eid-ul-fitr/ঈদুল ফিতরের নামাজের নিয়ম জেনে নিন
শবে কদরের আমল ও ফজিলত সম্পর্কে জেনে নিন
আরো নিয়োমিত তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন ভয়েস অফ দেশ